ফেসবুক থেকে:
নিবন্ধ (মোবাইল ভার্শন)
খাম্বাবাবা
শিশির বিশ্বাস
গল্পটা পুরোনো।
মধ্যপ্রদেশের বিদিশা জেলায় ছোট এক জনপদ বেশনগর। বিশেষজ্ঞদের
অনুমান‚ এখানেই ছিল সুপ্রাচীন বিদিশা নগরী। স্থানটি
বিশ্ববিখ্যাত সাঁচি স্তূপ থেকে মাত্রই পাঁচ মাইল দূরে। পাশ দিয়ে বয়ে
চলেছে বেশ নদী। অদূরেই এক আশ্রম। কয়েকজন সাধুর বাস।
আশ্রমের চত্বরে গাড় সিঁদুর লেপা একটি একশিলা স্তম্ভ। লম্বায় সাড়ে
ছয় মিটারের মতো। স্থানীয় মানুষের কাছে স্তম্ভটি অতি জাগ্রত দেবতা ‘খাম্বা বাবা’। প্রতিদিন পুজো
হয়। আর জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় খাম্বা বাবার উৎসবের মাসে পূণ্যার্থী আসে
দূরদূরান্ত থেকে। সৌভাগ্য এবং পুত্র লাভের আশায় বলি পড়ে।
স্তম্ভের গায়ে তেল–সিঁদুর
চড়ানো হয়। বিশ্বাস‚ খাম্বা অর্থাৎ স্তম্ভ রূপধারী বাবা স্বয়ং মহাদেব।
তাঁর কৃপায় কোনও আশাই অপূর্ণ থাকে না।
প্রবাদ‚
বহুকাল আগে হীরাপুরী নামে এক সাধু
এখানে বাস করতেন। হঠাৎই একদিন তাঁর আশ্রমে অতিথি হয়ে এলেন জটাজুটধারী এক
যোগীপুরুষ। হীরাপুরী সেই যোগীপুরুষকে দেখেই চিনতে পারলেন। আগন্তুক আর
কেউ নয়‚ স্বয়ং মহাদেব। তিনি সেই যোগীপুরুষকে তাঁর আশ্রমেই অবস্থান করতে
অনুরোধ করলেন। হীরাপুরীর সেবায় যোগীপুরুষ তুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি তাঁকে নিরাশ করলেন না। খাম্বার রূপ
ধরে আশ্রম প্রাঙ্গণে রয়ে গেলেন। খাম্বা বাবার মাহাত্ম্য চারপাশে ছড়িয়ে পড়েতে এরপর আর
দেরি হয়নি।
চলছিল এই ভাবেই। ১৮৭৭ সালের
জানুয়ারি মাসে স্তম্ভটি নজরে আসে আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম সাহেবের।
কোম্পানির শাসন অবসানের পরে তিনি তখন এদেশে আর্কিওলজিক্যাল দপ্তরের ডিরেক্টর
জেনারেল হয়ে এসেছেন। উৎসাহী মানুষটি প্রাচীন ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক
নিদর্শনের খোঁজে চষে ফেলছেন সারা দেশ। আশ্রমের চত্বরে যখন তিনি স্তম্ভটি দেখেন‚ সর্বত্র তেল–সিঁদুরের গাঢ় প্রলেপ। অনেক কিছুই
ঢাকা পড়ে গেছে। তবু জহুরির চোখে জহরত চিনতে ভুল হয়নি। স্তম্ভটি
দেখার পরে তিনি তাঁর রিপোর্টে লিখছেন‚
'perhaps the most curious and novel discoveries that I have ever made'। একশিলা
স্তম্ভটির গঠনশৈলী পর্যালোচনা করে তিনি এটিকে গুপ্তযুগের বলে সনাক্ত করেছিলেন।
সুপ্রাচীন স্তম্ভের গায়ে কিছু লিপি থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে।
কিন্তু তেল–সিঁদুরের
পুরু আস্তরণ থাকায় ক্যানিংহাম সাহেব তেমন কিছু খুঁজে পাননি। আশ্রমের
অনুমতি না মেলায় রং তুলে ফেলাও সম্ভব হয়নি।
হেলিওডোরাস স্তম্ভের নিম্নভাগে ব্রাহ্মী লিপি।
অগত্যা অপেক্ষা করতে হল আরও তিরিশটি বছর।
১৯০৯ সালে গোয়ালিয়র রাজ্যের সুপারিন্টেডিং ইঞ্জিনিয়ার মি. লেকের নির্দেশে স্তম্ভের গোড়ার দিকে কিছু অংশের সিঁদুর তুলে
ফেলা হতে প্রথম লিপির সন্ধান পাওয়া গেল। কিন্তু সবটা নয়। লিপির অনেকটাই তখনো ইট–পাথরে গাঁথা স্তম্ভের বেদীর তলায় রয়ে গেছে।
এর বেশি তখন আর এগোনো সম্ভব হয়নি। বলা যায় প্রকৃত অনুসন্ধান শুরু হয় এর পাঁচ বছর পরে
প্রত্নতাত্ত্বিক ড. ভাণ্ডারকারের
তত্ত্বাবধানে। পুরো দশ দিন লেগেছিল
স্তম্ভের রং পরিষ্কার করতে।
পুরোনো ভিত্তিপ্রস্তর ভেঙে ফেলে নতুন করে বসান হল স্তম্ভটিকে। খ্রিপূ সময়ের
ব্রাহ্মী হরফে লিখিত লিপিগুলি উদ্ধার হতে জানা গেল গুপ্তযুগ নয়‚ স্তম্ভটি আরও
কয়েকশো বছরের পুরোনো। খ্রিপূ ১ম শতকের। শুঙ্গ বংশীয়
রাজা কাশীপুত্র ভগভদ্রর বিদিশার রাজসভায় তক্ষশীলার ইন্দো-গ্রীক রাজা অ্যান্টিয়ালকিডাসের দূত ছিলেন হেলিওডোরস। গ্রীক রাজদূত হেলিওডোরস বিদিশায় বাসুদেব মন্দির
প্রাঙ্গণে ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে এক গড়ুর স্তম্ভ স্থাপনা করেছিলেন।
খাম্বা বাবা সেই স্তম্ভ। স্তম্ভলিপিতে হেলিওডোরস তাঁর আরাধ্য বাসুদেবকে
দেবাদিদেব বলে স্তুতি করেছেন।
কৌতূহলী পাঠকের জন্য প্রথম সাতটি লাইন বিবৃত করা যেতে
পারে:
১) দেবদেবস বাসুদেবস গরুড়ধ্বজ অয়ং।
২) কারিতে ইয় হেলিওদোরেণ ভাগ।
৩) বতেন দিয়স পুত্রেণ তখসিলাকেন।
৪) যোন দূতেন আগতেন মহারাজাস।
৫) অন্তলিকিতস উপতা সকারু রজো।
৬) কাসী পুত্র ভাগভদ্রস ত্রাতারস।
৭) বসেন চতু দশেন রাজেন বধমানস।
অর্থাৎ‚
দেবাদিদেব বাসুদেবের এই গড়ুরধ্বজা
তক্ষশিলা নিবাসী ডিয়ন পুত্র ভাগবত অনুরাগী হেলিওডোরাস কর্তৃক স্থাপিত‚ যিনি গ্রিক
রাজা অ্যান্টিয়ালকিডাসের রাজদূত রূপে কাশীপুত্র ভগভদ্রের রাজত্বকালের চর্তুদশ বছরে
তাঁর বিদিশার রাজ দরবারে আগমন করেন।
মূল রহস্যের সমাধান হলেও প্রশ্ন রয়ে গেল‚ বাসুদেবের সেই
মন্দির নিয়ে। কোথায় গেল সেটি? তবে কী স্তম্ভটি অন্য কোনও স্থান থেকে আনা হয়েছিল। স্থানটি পর্যবেক্ষণের পরে অনুমান করা গিয়েছিল‚ বর্তমান
আশ্রমটি হয়তো সেই মন্দিরের স্থানেই নির্মিত। ১৯৬৩–৬৫ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক এম.ডি খারে সেই আশ্রম-বাড়িটি ভেঙে সরিয়ে দিয়ে খনন কাজ শুরু
করতেই বের হয়ে পড়ল খ্রিপূ ৩য় শতকে নির্মিত উপবৃত্তাকার বিশাল এক মন্দিরের
ভিত। এযাবত কাল জ্ঞাত এইটিই ভগবান বাসুদেবের প্রাচীনতম মন্দির।
তক্ষশীলার গ্রিক রাজা অ্যান্টিয়ালকিডাসের রৌপ্যমুদ্রা।
মন্দিরের গর্ভগৃহের ক্ষেত্রফল ছিল ৮.১৩ বর্গ মিটার।
প্রদক্ষিণ পথ আড়াই মিটার চওড়া। এছাড়া বড় আকারের সভামণ্ডপ তথা দর্শন গৃহ। পাওয়া গেছে‚ সভামণ্ডপের এক কাঠের দরজার অস্তিত্ব।
শুধু বর্তমান স্তম্ভটি নয়‚ মন্দিরের পুব দিকে উত্তর–দক্ষিণ বরাবর আরও সাতটি স্তম্ভ ছিল।
হেলিওডোরাস স্তম্ভটি অষ্টম। বিভিন্ন সময়ে ভক্তবৃন্দ মঙ্গল কামনায় এগুলি
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান স্তম্ভটি ছাড়া আর কোনটিরই সন্ধান
মেলেনি।
অনুমান করা যায়‚
বাসুদেবের মন্দিরের প্রাঙ্গণে
হেলিওডোরসের স্তম্ভ সহ যে আটটি স্তম্ভ ছিল‚
কালের প্রভাব এবং পরবর্তীকালে
কালাপাহাড়ি তাণ্ডবে মন্দিরের সঙ্গে সেগুলিও ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমান
হেলিওডোরস স্তম্ভটিও অর্ধ ভগ্ন। স্তম্ভ শীর্ষের গড়ুর মূর্তিটি বিনষ্ট হয়ে গেছে।
সন্দেহ নেই‚ ভগ্ন মন্দির প্রাঙ্গনে ভগ্ন‚
অর্ধভগ্ন স্তম্ভগুলি হেলায় পড়ে ছিল।
পাথরগুলি যে যার মতো তুলে নিয়ে কাজে লাগিয়েছে। এইভাবেই এই সেদিন‚ ১৭৯৪ সালে
কাশীর রাজা চৈত সিংয়ের দেওয়ান জগত সিং সম্রাট অশোক নির্মিত সারনাথের বিখ্যাত
ধর্মরাজিকা স্তূপ থেকে ইট–পাথর
নিয়ে নিজের কাজে লাগিয়েছিলেন। বিখ্যাত স্তূপটি ওই সময় পর্যন্ত মোটামুটি ভাল
অবস্থাতেই ছিল। আজ এই স্তূপের ভিত্তিটুকু ছাড়া আর কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই।
যাই হোক‚
সম্ভবত ওই সময় আশ্রমের সাধু হীরাপুরী
অনাদরে পড়ে থাকা একটি স্তম্ভকে শিবজ্ঞানে ফের স্থাপনা করে পূজা শুরু করায় রক্ষা
পেয়ে গেছে হেলিওডোরাস স্তম্ভটি। হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের অন্তত একটি ছেঁড়া পাতা উদ্ধার
করা গেছে। অঞ্চলটিতে ব্যাপক অনুসন্ধান হলে ভগ্ন দু’একটি স্তম্ভও হয়তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
কিন্তু তা আর হয়নি। এ দেশের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের আরও কয়েকটি পাতা চাপা পড়ে
রয়েছে ওই অঞ্চলের মাটির তলায়। হয়তো কোনও দিন উদ্ধার করা যাবে।
স্থানটির কিছু পূর্ব দিকে খ্রিপূ ৩য় শতকে নির্মিত
একটি বৌদ্ধ স্তূপের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। স্তূপটি সাঁচি স্তূপের
পূর্ববর্তী।
প্রসঙ্গত আর একটি কথা বলতেই হয়। হেলিওডোরসের
এই গড়ুর স্তম্ভটির কল্যাণে বাংলা সাহিত্যে সংযোজিত হয়েছে একটি অনন্যসাধারণ
ঐতিহাসিক গল্প। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই স্তম্ভটিকে নিয়েই লিখেছেন
তাঁর বিখ্যাত ‘স্বপ্ন-বাসুদেব’ গল্পটি।
বিষয়টি তাঁকে এতটাই অনুপ্রাণিত করেছিল যে‚
তৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত গল্পটি তিনি
বার কয়েক ফিরে লিখেছিলেন। প্রায় দুই হাজার বছর আগে সেদিনের বিদিশা নগরী তথা
আজকের বেশনগরের এক চমৎকার ছবি আঁকা আছে এই গল্পে।
আলোকচিত্র: বিভিন্ন ওয়েবসাইটের সৌজন্যে।
১৬/১২/২০১৫
No comments:
Post a Comment