অগম কুয়া
শিশির
বিশ্বাস
অগম কুয়ার চতুর্দিকে আটটি অর্ধচন্দ্রাকার খিলানযুক্ত ইটের বেষ্টনী।
কখনো
বড়ো আক্ষেপ হয়। দেশটা আমাদের‚ অথচ সেই দেশের কথা, দেশের অতীত
ইতিহাস জানতে হয় ভিনদেশ থেকে। অতীত কথা আমরা যে একেবারেই লিখিনি‚ তা
নয়। কিন্তু সেসব বড়ই গোলমেলে। কখনও রূপক‚ কখনো হেঁয়ালিতে লেখা। ভুরি ভুরি
উদাহরণ দেওয়া যায়। খুব ছোট একটা উদাহরণ দেই। আর্য–মঞ্জুশ্রী–মূলকল্প নামে একটি
বৌদ্ধ গ্রন্থে এদেশের কয়েকজন রাজার কথা আছে। সেই কাহিনীগুলির একটি মধ্যদেশের দুই
খ্যাতনামা রাজার। যাঁদের প্রথম জনের নাম ‘র’ আদ্যক্ষর যুক্ত। তিনি যুদ্ধে নিহত হলে
রাজা হয়েছিলেন তাঁর ছোট ভাই। যাঁর নামের আদ্যক্ষর ‘হ’। রাজা
‘হ’ অনেক যুদ্ধে জয়লাভ করে রাজচক্রবর্তী হয়েছিলেন। যাঁদের তিনি যুদ্ধে পরাজিত
করেছিলেন‚ তাঁদের একজন সেসময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা ‘সোম’।
আর্য–মঞ্জুশ্রী–মূলকল্পে
উল্লেখিত এই রাজা ‘র’–এর প্রকৃত নাম যে রাজ্যবর্ধন‚ ‘হ’ হলেন
হর্ষবর্ধন আর ‘সোম’ বঙ্গরাজ শশাঙ্ক‚ তা চৈনিক পরিব্রাজক হিউ–এন–সাংয়ের বিবরণ
ছাড়া জানা সম্ভব ছিল না। তবু বৌদ্ধ গ্রন্থে ইঙ্গিত তুলনায় স্পষ্ট। কিন্তু এ
ব্যাপারে আমাদের পুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থ আরো জটিল। সেসব জটিল রূপক কাহিনী ভেদ
করে প্রকৃত ইতিহাস খুঁজে বের করা আজ পণ্ডশ্রম মাত্র।
আসলে
আমরা ভারতবাসী ইতিহাসকে কোনও দিনই সেই অর্থে গুরুত্ব দিইনি। ব্যতিক্রম আজও নয়। তাই
কলকাতায় ইংরেজ আমলের দুই অতি ব্যস্ত রাস্তা চৌরঙ্গী আর ধর্মতলা রোডের নাম অবলীলায়
বদলে দেওয়া হয়। অথচ এই রাস্তা দুটি যাঁদের হাতে তৈরি
সেই ইংরেজ জাতি ইতিহাস সচেতন ছিলেন বলেই অমন দেশীয় নাম রাখতে দ্বিধা করেননি। শোনা যায়‚ কলকাতা
শহরের পত্তনের সময় ওই অঞ্চলে ‘চৌরঙ্গী’ নামে এক নাথপন্থী সাধুর আশ্রম ছিল। সেই
কারণ স্থানীয় মানুষের কাছে অঞ্চলটি চৌরঙ্গী নামেই পরিচিত ছিল। রাস্তা তৈরির সময়
সেই নামটি আর বদল করা হয়নি। আর ধর্মতলা অঞ্চলে ছিল লৌকিক দেবতা ধর্মঠাকুরের থান। সেসময়
গ্রাম বাংলার গাছতলায় কালো পাথর স্থাপনা করে ধর্মঠাকুর জ্ঞানে পুজো করা হতো। বাংলা
সাহিত্যে পরিচিত ধর্মমঙ্গল কাব্যে এই ধর্ম ঠাকুরের মাহাত্ম্যর কথাই রয়েছে। সেকালে
ধর্মতলা অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত সেই ধর্মঠাকুরের থান বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি
রোডের তালতলা মোড়ের কাছে আজও রয়েছে। তবে এখন আর সেটি ধর্মঠাকুরের থান নয়‚
পরিচিত শীতলা মন্দির নামে। দুই দালান বিশিষ্ট মন্দিরের ভিতরের দালানে বিগ্রহের
বেদীতে শীতলা‚ ষষ্ঠী প্রভৃতির মূর্তির সঙ্গে ছোট আকারের একটি কালো পাথরও বর্তমান।
একসময়ে এই পাথরটিই যে ধর্মঠাকুর‚ রূপে পূজিত হতেন‚ আজ
অনেকেরই জানা নেই।
ধর্মতলা
রোড নামটা অনেক দিন মুছে গেলেও কিছু মানুষের স্মৃতিতে টিকে আছে এখনো। সন্দেহ নেই
হারিয়ে যাবে অচিরেই। হয়তো এভাবেই হারিয়ে গেছে পাটনা শহরের এক গুরুত্বপূর্ণ
ঐতিহাসিক স্থান। আজ স্থানীয় মানুষের কাছে যার পরিচিতি অগম কুয়া বা শীতলা মন্দির।
পাটনা শহরের বাইরে খুব কম ব্যক্তিই নামটি শুনেছেন। জানা ছিল না বর্তমান
প্রতিবেদকেরও। হঠাৎই হদিশ বিবিসি’র একটি ডকুমেন্টারি ভিডিও ‘The
Story of India’ থেকে। ঐতিহাসিক মাইকেল উড’এর উপস্থাপনায় ৬ পর্বের অসাধারণ এই ভিডিওটি
যাঁরা দেখেননি‚ দেখতে অনুরোধ করব।
যাই
হোক কিছু কৌতূহলী হয়ে অতঃপর শুরু হল খোঁজখবর। পাটনা শহরে গুলজারবাগ রেল স্টেশনের
অদূরে ‘অগম
কুয়া’ নামে
পরিচিত এই কুয়াটি আক্ষরিক অর্থেও ‘অগম’ অর্থাৎ অগম্য।
গভীরতা একশো পাঁচ ফুটের উপর। আর বেড় কুড়ি ফুটেরও বেশি। এত বড় আকারের এক কুয়ো খনন
যে সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়‚ স্থানীয় দেহাতি মানুষেরও বুঝতে
অসুবিধা হয়নি। তাই নানা প্রবাদ আর গল্পকথা প্রচলিত
ছিল কুয়োটিকে নিয়ে। কিন্তু এদেশের কোনও সুধীজন মাথা ঘামাবার প্রয়োজন বোধ করেননি।
খ্রিপূ ১ম শতকের শিল্পকলা সমৃদ্ধ দু’দিকে দুই যক্ষীমূর্তি সম্বলিত একটি প্রস্তর স্তম্ভের ভগ্নাবশেষ। ১৮৯৫ সালে তোলা অগম কুয়া চত্বরে আলোকচিত্রটির সঙ্গে স্থানীয় কিছু পূণ্যার্থী মহিলাকেও দেখা যাচ্ছে। বেশ বোঝা যায়‚ আলোকচিত্রটি যখন তোলা হয়‚ তখন মাটি খুঁড়ে ভগ্ন স্তম্ভটি উন্মুক্ত করার কাজ চলছে। অমূল্য প্রত্ন
সামগ্রীটি বর্তমানে কোথায়‚ জানা নেই।
এদেশের
আর পাঁচটি ঐতিহাসিক স্থানের মতো এখানেও একদিন চোখ পড়ল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের। অনুসন্ধানে
জানা গেল‚ অগম কুয়ার
গঠনেও রয়েছে কিছু অস্বাভাবিকতা। সুগভীর এই
কুয়োর উপরের চুয়াল্লিশ ফুট ইটের হলেও নীচের বাকি অংশ কাঠের চাক বা বা রিং দিয়ে
বাঁধানো। প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম ১৮৭৯–৮০ সালে
স্থানটি যখন পরিদর্শন করেন‚ স্থানটির চারপাশে তখন একাধিক
সুপ্রাচীন কাঠামোর ভগ্নাবশেষ বর্তমান।
১৮৯০
সালে প্রত্নতাত্ত্বিক লরেন্স ওয়েবেল কুয়োটির অদ্ভুত গঠন আর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা
একাধিক প্রাচীন ভগ্নাবশেষ দেখে এটিকে মৌর্য যুগের বলে সনাক্ত করেন। তাঁর এই
সিদ্ধান্তের পিছনে যথেষ্ট কারণ ছিল। প্রথমত‚ কুয়োটির
গঠন। আমরা জানি‚ সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হবার পরে প্রায়
হাজার বছরেরও বেশি এদেশে পোড়া ইটের ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। মৌর্য সম্রাটদের
রাজধানী পাটলিপুত্র গড়ে উঠেছিল প্রধানত কাঠ আর পাথর দিয়ে। গ্রিক রাজদূত
মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায়‚ প্রতিরক্ষার
কারণে পাটলিপুত্র নগর বেষ্টন করে বিশাল এক কাঠের প্রাচীর ছিল। বর্তমান পাটনা শহরের
বিভিন্ন স্থানে মাটির তলায় সেই প্রাচীরের অনেক অংশের সন্ধান পাওয়া গেছে। অনুমান
করাই যায়‚ সেই সময় পাটলিপুত্র নগরে কুয়োর চাকও
তৈরি হত কাঠ দিয়ে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে‚ তাহলে কুয়োর
উপরের অংশ ইটের কেন?
উত্তর
হল‚ ইতিহাস হারিয়ে গেলেও স্থানটিকে ঘিরে বেঁচে রয়েছে কিছু
জনশ্রুতি। স্থানীয় প্রবাদ‚ জৈন
সন্ন্যাসী সুদর্শনের প্রতি ক্রদ্ধ হয়ে রাজা চণ্ড (এই রাজা চণ্ড যে স্বয়ং সম্রাট
অশোক‚ সেই
প্রসঙ্গে পরে আসছি) তাঁকে হত্যা করার জন্য এই কুয়োর ভিতর নিক্ষেপ করলেও অলৌকিক
শক্তিবলে তিনি জলের উপর বিশাল এক পদ্মের উপর ধ্যানরত অবস্থায় ভেসে ছিলেন। রাজা
চণ্ডের উদ্দেশ্য তাই সফল হয়নি। এমন আরও কিছু জনশ্রুতির কারণে সুপ্রাচীন কাল থেকে
এই সুগভীর কুয়োটি স্থানীয় হিন্দু এবং জৈন সম্প্রদায়ের কাছে এক অতি পুণ্যস্থান বলে
গণ্য। সেই বিশ্বাসে ছেদ পড়েনি কখনো। কালে কূপের
উপরের অংশের কাঠের চাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে‚ ভূস্তরের
উচ্চতা বেড়েছে‚ নতুন করে বাঁধাতে হয়েছে সেই অংশ।
ততদিনে শুরু হয়েছে পোড়া ইটের ব্যবহার। সংস্কারের কাজে তাই কাঠের চাকের বদলে
ব্যবহার হয়েছে ইট। এইভাবে উপরে ইটে বাঁধানো অংশ ক্রমশ ৪৪ ফুটে পৌঁছে গেছে। নীচের
কাঠের অংশ তেমনই রয়ে গেছে।
অগম
কুয়ার প্রসঙ্গে সম্রাট অশোকের কথা বলতেই হয়। প্রবাদ‚ তিনি তাঁর
৯৯ জন ভাইকে এক সুগভীর কূপে নিক্ষেপ করে হত্যা করেছিলেন। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের
বৌদ্ধ গ্রন্থ অশোকাবদানেও বিষয়টির উল্লেখ আছে। অশোক প্রথম জীবনে অত্যন্ত নিষ্ঠুর
প্রকৃতির ছিলেন। সিংহাসন নিষ্কণ্টক করার জন্য তিনি শুধু ভাইদের নয়‚ হত্যা
করেছিলেন পিতার আমলের একাধিক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীকেও। অতি সামান্য সন্দেহেও
রেহাই ছিল না। এজন্য তিনি একটি উৎপীড়ন কক্ষ নির্মাণ করেছিলেন। অশোকাবদান গ্রন্থে
উল্লেখ আছে‚ চণ্ডগিরীকা নামে অতি নিষ্ঠুর
প্রকৃতির এক ব্যক্তিকে এই কক্ষের প্রধান নিযুক্ত করা হয়েছিল। রাজ আদেশে অভিযুক্ত
ব্যক্তিদের তিনি এখানে নৃশংস ভাবে হত্যা করতেন। চৈনিক পরিব্রাজক ফা–হিয়েনের
বিবরণেও এই তথ্যের সমর্থন মেলে।
পাটনা শহরের বুলন্দবাগ অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত সুপ্রাচীন
পাটলিপুত্র নগরের কাঠের প্রাচীরের অবশেষ। এই প্রাচীরের কথাই গ্রিক রাজদূত মেগাস্থিনিস তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করে গেছেন।
জৈন
গ্রন্থে সন্ন্যাসী সুদর্শনের কথা থাকলেও অশোকাবদানে রয়েছে বৌদ্ধ অর্হৎ সমুদ্রর
কথা। চণ্ডগিরীকা তাঁকে এই উৎপীড়ন কক্ষে পূতিগন্ধময় রক্ত প্রভৃতি পূর্ণ এক ফুটন্ত
কূপের ভিতর নিক্ষেপ করেছিলেন। কিন্তু অর্হৎ সমুদ্রর কোনও অনিষ্ঠ হয়নি। তিনি সেই
ফুটন্ত তরলে একটি পদ্মফুলের উপর নিরাপদে ভেসে ছিলেন। ফুটন্ত তরল তাঁকে স্পর্শ করতে
পারেনি। লক্ষণীয়‚ জৈন এবং বৌদ্ধ দুই সন্ন্যাসীর নাম
ভিন্ন (যদিও কিছু সাদৃশ্য বর্তমান) হলেও পরিণাম উভয় ক্ষেত্রেই এক!
যাই
হোক‚ এই
অদ্ভুত ঘটনা সম্রাট অশোককে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। নতজানু হয়ে তিনি অর্হৎ
সমুদ্রর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। শুনেছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসার বাণী। বলা
হয়‚ সেই
উৎপীড়ণ কক্ষেই চণ্ডাশোক পরিবর্তিত হয়েছিলেন ধর্মাশোকে। সম্রাটের নির্দেশে সেই উৎপীড়ণক্ষেত্র
অতঃপর তীর্থক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়েছিল। নির্মাণ করা হয়েছিল একাধিক সুদৃশ্য সৌধ‚ বৌদ্ধ
চৈত্য। বর্তমান অগম কুয়াই কি সেই পুণ্যস্থান?
অগম কুয়া চত্ত্বরে বর্তমান শীতলা মন্দির। এই স্থানেই কি ছিল অশোক নির্মিত
বৌদ্ধ চৈত্য অথবা স্তূপ? বতর্মান মন্দিরটি কি সেই ভগ্নাবশেষের উপরে নির্মিত?
১৮৯৫
সালের অগম কুয়া চত্বরের একটি আলোকচিত্র পাওয়া যায়। ছবিতে
স্থানীয় কিছু পূণ্যার্থী মহিলার সঙ্গে খ্রিপূ ১ম শতকের শিল্পকলা সমৃদ্ধ দু’দিকে দুই
যক্ষীমূর্তি সম্বলিত একটি প্রস্তর স্তম্ভের ভগ্নাবশেষও রয়েছে। দেখে বেশ বোঝা যায়‚ আলোকচিত্রটি
যখন তোলা হয়‚ তখন মাটি খুঁড়ে ভগ্ন স্তম্ভটি
উন্মুক্ত করার কাজ চলছে। অমূল্য প্রত্ন সামগ্রীটি বর্তমানে কোথায়‚ জানা নেই।
প্রকৃতপক্ষে
অগম কুয়ার চত্বরে কোনও প্রত্ন নিদর্শনই আজ আর অবশিষ্ট নেই। বলা যায়‚ লুঠ হয়ে
গেছে। কুয়োটির চারপাশে আটটি অর্ধচন্দ্রাকার খিলানযুক্ত যে ইটের বেষ্টনী দেখা যায়‚ সেটি
পরবর্তীকালের। কাছে আর রয়েছে শীতলা মায়ের সুদৃশ্য এক মন্দির। সেটিও সাম্প্রতিক।
প্রতিদিন
শত–শত
পূণ্যার্থী এখানে আসেন পুজো দিতে। বিবাহ উপলক্ষে নতুন বধূকে নিয়ে ছুটে আসেন বাড়ির
সবাই। নবদম্পতির কল্যাণ কামনায় অগম কুয়ার চত্বরে লোকগানের আসর বসে। বিশ্বাসটি বহু
প্রাচীন। বিবিসি’র
তৈরি ছবিতে এমন একটি দৃশ্যও ধরা আছে।
আলোকচিত্র:
বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত।
No comments:
Post a Comment