Monday 4 January 2016

হাসির গল্প (মোবাইল ভাঃ): রহস্যটা অতি সরল (শিশির বিশ্বাস)



জামাইষষ্ঠীর দুপুর জুতসই একটা শিকারের সন্ধানে নটবর অনেকক্ষণ ধরে ঘুরঘুর করছে কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় জুতোর দোকানগুলোর সামনে কিন্তু এখনো সুবিধে করা যায়নি ওদিকে দমদম স্টেশনে বউ বসে রয়েছে তার অপেক্ষায় যা দজ্জাল, দেড়টার ট্রেন ফেল হলে আর দেখতে হবে না অগত্যা ভেবে অন্য কোথাও ঢুঁ মারবে কিনা ভাবছে, এমন সময় একেবারে লে ছক্কা! কপাল বলে একেই!
নটবর অনেক দিনের পুরনো ঘাগি রাতের অন্ধকারেও শিকার চিনতে ভুল হয় না আর এ তো দিনদুপুর অবশ্য নটবরকে দেখে এখন আর বোঝার উপায় নেই যে, সে-ই হচ্ছে চোরপট্টি লেনের পয়লা নম্বর রত্ন শ্রীযুক্ত নটবর সামন্ত নটবর সকাল সন্ধে তার ঘরের তক্তপোশে হাত পা ছড়িয়ে ভোঁস-ভোঁস করে কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোয় পাশের গ্যারেজে মোটর গাড়ির মিস্ত্রিরা ঢাঁই-ঢাঁই শব্দে সারাদিন লোহা পেটায় নটবরের ঘুম তাতে আরও গভীর হয় বেপাড়ার ছোঁড়াগুলো মড়া কাঁধে ইয়াহু-ইয়াহু চিৎকারে নাচতে-নাচতে যায় খোদ মড়া পর্যন্ত সেই চেল্লানিতে উঠে বসতেও পারে হয়তো, অথচ নটবরের নাক ডাকা বাড়তেই থাকে
কিন্তু যেই রাত ঠিক একটা বাজে, গলির মোড়ে গির্জার ঘড়ি বেজে ওঠে ঢং করে নিমেষে তক্তপোশের উপর উঠে বসে নটবর চোখ দুটো কচলে নিয়ে ধুতিটা হাঁটুর উপর তুলে কাছা মেরে শক্ত করে জড়িয়ে নেয় কোমরে তারপর থলেয় সিঁধকাঠি সমেত দুএকটা যন্ত্রপাতি আর এক শিশি হনুমান মার্কা কাচ্চি ঘানি সর্ষের তেল নিয়ে বের হয়ে পড়ে ফেরে একেবারে সেই শেষ রাত্তিরে থলে ভরতি করে তারপর সেটা বউয়ের সামনে নামিয়ে দিয়েই ফের ঘুম গেরস্ত বা পুলিশ তার টিকির নাগালটিও পায় না একবার এক খ্যাংরা-পটকা পুলিশ কী মনে করে পিছু নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল প্রায় দোর গোড়ায় কিন্তু দজ্জাল বউয়ের মুখনাড়ায় মোটেই সুবিধে করতে পারেনি দুমিনিটেই বোল্ড হয়ে সরে পড়েছিল
নটবরের দুঃখ একটাই বউ নেত্য একেবারেই মান্যি করে না কথায় কথায় খোঁটা, মুখঝামটা লেগেই আছে সিঁধেল চোরের নাকি আজকালপেসটিজনেই সে এখন ওই গাঁটকাটাদের অথচ বাবুদের বাক্স-প্যাঁটরা হাতিয়ে বউয়ের গয়না, কাপড়, অভাব রাখেনি কিছুর ব্যাপারটা আরও বেড়েছে হতভাগা গদাইটা হঠাৎ পালটি খাওয়ায়
এই চোরপট্টিতেই তখন বাসা ছিল গদাইয়ের দুজন তখন হরিহর আত্মা রাতে একসাথে বের হত সিঁধকাঠির কাজ, জানলার গরাদ বাঁকানো বা নিমেষে পাইপ বেয়ে উপরের তলায় পৌঁছে যাওয়ার কায়দা একই গুরুর কাছে শেখা কিন্তু ভীমরতি ছাড়া কী! সেই গদাই হঠাৎ লাইন পালটে ভিড়ে পড়ল পকেটমার মানে বউয়ের কথায় গাঁটকাটার দলে গুরুর নিদান সর্ষের তেল ছেড়ে গায়ে চাপাল কোট-প্যান্ট সঙ্গে বাহারি টাই রাত ছেড়ে সকাল-বিকেল বাসে নয়তো ট্রেনে সাহেব সেজে ডিউটি রাত দুপুরে উদোম গায়ে সিঁধকাঠি হাতে বের হবার দিন নাকি আর নেই সর্ষের তেল নয়, এখন গায়ে কোট-প্যান্ট চাপিয়ে ট্রেনে-বাসে পকেট কাটার যুগ গদাই ওকেও ভজাবার চেষ্টা কম করেনি কিন্তু নটবর কানে তোলেনি
বউয়ের মুখঝামটা বাড়ার পিছনে সেটাও এক কারণ কোট-প্যান্টের বদলে খালি গায়ে সর্ষের তেল মেখে ডিউটিতে বের হওয়া বর কার আর পছন্দ হয়? চোখ তো টাটাবেই তা ভাগ্যিস, এত কিছুর পরেও লাইন ছাড়েনি! হতচ্ছাড়া গদাই বছর ঘোরার আগেই হাতেনাতে ধরা পড়ে পাবলিকের আড়ং ধোলাই খেয়ে জেলের ঘানি টানছে এখন
তা সেই বউ হঠাৎ বায়না ধরেছে ষষ্ঠীতে বাপের বাড়ি যাবে অনেক দিন যাওয়া হয়নি ষষ্ঠীতে শ্বশুরবাড়ি মানেই শ্বশুর-শাশুড়ির প্রণামির ধুতি-শাড়ি তো বটেই সঙ্গে শালা-শালির দলও রয়েছে এর উপর বউয়ের শাড়ি, নিজের ধুতি-পাঞ্জাবি বউয়ের বিপুল ফরমাশ শুনে চোখে সর্ষে ফুল দেখলেও নটবর টুঁ শব্দটিও করেনি করলেই সিঁধেল চোরের কেরামতি নিয়ে হাজার খোঁটা শুনতে হবে অগত্যা গত রাতে একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়েছিল গির্জার ঘণ্টার জন্য অপেক্ষা করেনি তার আগে অনেক হিসেব করতে হয়েছে এরিয়ার হাল-হকিকত নখদর্পণে ঠিকই কোন বাড়িতে কয়টা জামাই, কেমন আয়োজন কিন্তু তারপরেও রয়েছে অনেক ব্যাপার আসলে দিনকাল বেজায় খারাপ
গুরুর কাছে শেখা বিদ্যে অবশ্য মার যায়নি সব জোগাড় করতে একে একে হানা দিতে হয়েছে তিন তিনটে বাড়িতে ফিরতে প্রায় ভোর কিন্তু কপাল কে খণ্ডাবে! ভেবেছিল, বউ খুশিতে দুটো ভাল কথা শোনাবে চাহিদার কিছুই বাকি রাখেনি কিন্তু কোথায় কী! বউ খানিক দেখেই খেঁজি মেরে উঠল, ‘এই না হলে সিঁধেল!’
-কেন!’ খাবি খেয়ে নটবর বলল, ‘সবই তো আনা হয়েছে বাকি রাখিনি কিছুই
সিঁধেলের বুদ্ধি আর কত হবে বলি তোমার ধুতি পাঞ্জাবি তো দেকছি তা জুতো কোতায়?
জুতো!’ দুচোখ গোল্লা করে প্রায় খাবি খেল নটবর সত্যি জুতোর কথা মনেই পড়েনি আসলে রাতের কাজ খালি পায়ে আর দিনভর চিৎপাত হয়ে ঘুম জুতো পায় দেবার সময় কোথায়? কিন্তু সেকথা না ভেঙে অল্প মাথা চুলকে বলল, ‘কেন? সেবার এক বাড়ির প্যাঁটরা হাতিয়ে একজোড়া নাগরা এনেছিলুম যে!’
এনেছিলুম যে!’ মুখ ঝামটা দিয়ে বউ বলল, ‘এই না হলে সিঁধেলের বুদ্ধি!’
বউ সেই দণ্ডেই তক্তপোশের তলা থেকে টেনে বের করল সেই নাগরা এক দিনও পায়ে গলানো হয়নি ধুলো আর ঝুলকালিতে কাহিল অবস্থা আনকোরা শান্তিপুরি ধুতি আর গরদের পাঞ্জাবির সাথে বেজায় বেমানান বেচারার মুখে অগত্যা কথা নেই আর
নটবরের আজ কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় ঘুরঘুর করার পিছনে এই হল ব্যাক গ্রাউন্ড এক জোড়া জুতো চাই আজ বউ অবশ্য নাক সিটকে বলেছিল, ‘কেরামতি করে আর কাজ নেই সিঁধেলের জারিজুরি দিনদুপুরের ঢনঢন অমন যে সাহেব মানুষ গদাইদা, সেই কিনা ঘোল খেয়ে গেল! বরং ট্যাকা দিচ্ছি, জুতো একজোড়া কিনে নাওগে
ব্যাপার হল, বউয়ের সেই কথায় নটবরের আঁতে বেজায় ঘা পড়েছে দিন রাত্তির সিঁধেল চোরের খোঁটা! জেলের ঘানি টানা গদাইও কিনা সাহেব! আজ দেখিয়ে দেবে নটবর গাঁট কাটতেও দড় কম নয়
মতলব এঁটে তাই আগেই বেরিয়ে পড়েছে বউকে বলা আছে মালপত্র নিয়ে দমদম স্টেশনে অপেক্ষা করতে দেড়টার বনগাঁ লোকাল ধরবে নটবর তার মধ্যেই জম্পেশ একজোড়া জুতো হাতিয়ে পৌঁছে যাবে দিনরাত্তির খোঁটা দেওয়ার শোধ তুলবে আজ অবশ্য নটবরকে দেখে এখন আর চোরপট্টি লেনের সিঁধেল বলে বোঝার উপায় নেই গদাইয়ের মতো সাহেব না হলেও গিলে করা ফিনফিনে গরদের পাঞ্জাবি, কোঁচানো শান্তিপুরি ধুতিতে ফিটবাবু শুধু পায়ের পুরনো নাগরাটাই যা বেমানান যাই হোক, দেড়টার ট্রেনের কথা ভেবে যখন কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে ঠিক তখনই একেবারে মনের মতো শিকার!
তল্লাটে সবচেয়ে বড় দোকান থেকে বগলে রঙিন ফিতেয় বাঁধা ঢাউস এক রংচঙে জুতোর বাক্স নিয়ে রাগে গরগর করতে করতে প্রায় রামগরুড়ের ছানার মতো বের হলেন তিনি মাঝবয়সী মাথা-জোড়া তেল চুকচুকে টাক নাকের নীচে প্রজাপতি মার্কা গোঁফ দিব্যি নাড়ুগোপাল চেহারা বুঝতে অসুবিধা হয় না, দামে মোটেই জুত করেতে পারেনি তা বাপু, তুমি অমন রঙিন ফিতেয় বাঁধা রংচঙে ঢাউস বাক্সে এক জোড়া জম্পেশ জুতো বগলদাবা করে দুনিয়া সুদ্ধু সবাইকে দেখাতে-দেখাতে নিয়ে যাবে, আবার দামেও জুত করবে, দুটো কখনও একসাথে হয়? এই যে নটবরচন্দ্র গত রাতে এক ফোঁটা বিশ্রাম পায়নি, তা সত্ত্বেও আজ সেই থেকে এখানে ঘুরঘুর করতে লেগেছে, সে তো পছন্দসই জিনিসের জন্যই! সুতরাং মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে নটবর জুতোর বাক্স বগলে সেই নাড়ুগোপালের পিছনে ফেভিকুইক আঠার মতো সেঁটে গেল
নাড়ুগোপালকে শেষ পর্যন্ত পাকড়াও করা গেল একেবারে সেই শিয়ালদা স্টেশনে খালি পাকড়াও নয়, নটবর বিলকুল পেড়েও ফেলল তাকে বিরাট ভিড় স্টেশনে জামাইষষ্ঠীর দিনে ছানাপোনা সুষ্ঠু সবাই চলেছে শ্বশুরবাড়ি টিকিট ঘরের সামনে বিরাট ভিড় লম্বা লাইনে হুড়োহুড়ি কাণ্ড দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি সুযোগ বুঝে এবার ভালোমানুষের মতো এগিয়ে গেল নটবর
কী ভাবছেন সার? টিকিট কাটবেন তো? কাউন্টারের ওই জটলার ভিতর হাত-পা খেলিয়ে ঢুকে পড়ুন নইলে…’
ক্যা!’ দাঁতে দাঁত চেপে লোকটা বিড়বিড় করে কী বকছিল সমানে হঠাৎ দাঁত দুপাটি এমন কড়াৎ করে উঠল যে, মাঝপথেই থেমে পড়তে হল নটবরকে ঢোঁক গিলে মাথার চাঁদি চুলকে বলল, এই বলছিলাম কী, যা ভিড় ওদিকে, জুতোর বাক্সটা ভাল করে সামলে না রাখলেই মুশকিল হাজার হোক নতুন জুতো কিনা তেমন বুঝলে আমার হাতেও দিতে পারেন এইটুকু উপকার করতে না পারলে আমরা আর মানুষ কেন?’
লোকটার চোখ দুটো কেমন জুলজুল করে উঠল হঠাৎ বাটার-ফ্লাই গোঁফ জোড়া শিকারি বেড়ালের মতো ফুলে উঠল খরখরে গলায় বললেন, ‘মানুষ আর কোথায়? সব বনমানুষ মশাই বনমানুষ
রেগে যাওয়ার কথা নটবরের একেই রং কালো তার উপর ফি রাতে সর্ষের তেল মেখে আরও খোলতাই হয়েছে তাই নিয়ে প্রায়ই বউয়ের গজগজ কিন্তু নটবরের উপায় নেই নইলে এতদিনে তারও গদাইয়ের মতো জেলের ঘানি টানার কথা সেবার এক বাড়িতে কী ভয়ানক ব্যাপারটাই না হতে যাচ্ছিল! জানলার গরাদ বেঁকিয়ে সবে মাথা গলিয়েছে, টের পেয়ে জাপটে ধরেছিল ষণ্ডা মতো একজন কিন্তু সুবিধা করতে পারেনি কাচ্চি ঘানির দৌলতে চ্যাং মাছের মতো পিছলে বেরিয়ে নিমেষে অলিম্পিক দৌড় ভাগ মিলখা ভাগ তাই যে যাই বলুক, গুরুর বিধান হনুমান মার্কা কাচ্চি ঘানি ছাড়ার উপায় নেই তা সেই বউও বনমানুষ বদনাম দেয়নি ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গেলেও নটবর কিছুমাত্র চটল না এক গাল হেসে বলল,সারের মেজাজটা আজ ঠিক নেই দেখছি!’
তা হবেনাড়ুগোপাল প্রায় রে-রে করে উঠলেনবলে কিনা এটা নতুন জুতোর দোকান মশাই পুরনো জুতো রাখা হয় না এত করে বললুম, কিছুতেই শুনলে না! এদিকে জামাইষষ্ঠীতে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি জুতো কিনলুম নগদ দেড় হাজার টাকায় কী ভয়ানক বলুন দেখি!’
তা বটে তা বটেসান্ত্বনা দিল নটবরনতুন জুতোর সঙ্গে দুএক পাটি পুরনো জুতো দোকানে না রাখাটা খুবই অন্যায় কবে যে ব্যাপারটা বুঝবে এরামনে-মনে বলল, এই বুদ্ধি না হলে তুমি আর চোরপট্টির নটবরকে বনমানুষ বলো!
লোকটা যেন কিছু ঠাণ্ডা হল এবার দেখে নটবর ফের উৎসাহ দিল, ‘কী বলব সার, এটা কলকাতা বলে কথা এখানে কার ভাল কে আর দেখছে বলুন? আমার মতো দুচারজন যারা আছি, কত দিক সামলাই বলুন তো! নেহাত সামনে পড়ে গেলেন বলেই না সামান্য উপকারটুকু করব বলে ছুটে এলাম
বলতে-বলতে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল নটবর আর নাড়ুগোপালও সাড়া দিয়ে বাক্সটা সবে বগল থেকে বের করেছেন খোনা গলায় স্টেশনের লাউড স্পিকারটা হেঁকে উঠল, ‘রানাঘাট লোকাল বারা বাজকে বিশ মিনিট পর দো লম্বর প্ল্যাটফর্ম সে ছোড়েগি
এই যাহ্‌!’ ভয়ানক চমকে উঠে নাড়ুগোপাল ফের বাক্সটা বগলে চালান করে দিয়েই পড়ি কী মরি করে দুনম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে দৌড় লাগালেন সুতরাং নটবরও ছুটল পিছনেঘাবড়াবেন না সার চলুন, আপনাকে ট্রেনে তুলে দিচ্ছি টিকিটের জন্য চিন্তা করবেন না এ লাইনে আমার তিন তিনটে মামা টিকিট চেকার
সত্যিই টিকিট-ফিকিট কিচ্ছু লাগল না গেটে দাঁড়িয়ে-থাকা চেকারের নাকের ডগা দিয়ে গণ্ড-গণ্ডা মানুষের সাথে প্রায় রকেটের গতিতে পার হয়ে গেল দুজন কিন্তু রানাঘাট লোকালের এ কী অবস্থা! মানুষ তো ছার, দরজা দিয়ে একটা সুচ গলে সাধ্য কী! নাড়ুগোপাল সেই পেল্লায় বাক্স বগলে বৃথাই এক দরজা থেকে আর এক দরজায় ঢুঁ মারতে লাগলেন দেখে হাঁ-হাঁ করে উঠল নটবর, ‘আহা! করেন কী করেন কী সার! ওভাবে হয় কখনও? চেপটে যাবে যে!’
তবে?’ কপালের ঘাম মুছে নাড়ুগোপাল হাঁসফাঁস করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন
আমায় দিন সার দেখুন, কেমন আলগোছে পাচার করে ফেলিপ্রায় ছোঁ মেরে নটবর তার বগল থেকে ছিনিয়ে নিল বাক্সটা তারপর কী এক দারুণ কায়দায় দরজায় বাদুড়ঝোলা মানুষগুলোর ঠ্যাংয়ের ফাঁক দিয়ে ভিতরে সেঁধিয়ে একজনের বগলের তলা দিয়ে হাত গলিয়ে নাড়ুগোপালকেও দিব্যি টেনে তুলে ফেলল ভোঁ---প্আওয়াজ করে ছেড়ে দিল ট্রেনটাও
দেখলেন তো সার, ভদ্রলোকের এক কথা কিনা? আপনার জুতোয় আঁচড়টিও পড়তে দিইনিভিড়ের ভিতর একগাল হেসে ব্যক্ত করল নটবর কিন্তু নটবরের সেই নাড়ুগোপাল জুতোর বাক্স দেখবেন কী! দুজনের মাঝে ডজন কয়েক মানুষের পাঁচিল তারপর উঠবার সময় কার খানিকটা দাড়ির ডগা দাঁতে ছিঁড়ে এসেছে থুঃ-থুঃ করে তাই ফেলতে-ফেলতে একগাল কৃতার্থের হাসি হাসলেনওঃ! খুব উপকার করলেন যা হোক আপনার মতো মানুষ আরও গণ্ডায়-গণ্ডায় জন্মাক জয়জয়কার হোক
লোকটা আরও কী সব বলছিলেন ওদিকে ভিড়ের ভিতর দাঁড়িয়ে নটবর তখন মুচকি হাসছে দমদম পর্যন্ত যাওয়া যেতেই পারত সুবিধা হত কিন্তু ঝুঁকি নিল না ট্রেন উল্টোডাঙা আসতেই ভিড় গলে সুড়ুত করে নেমে পড়ল নামার সময় কার কোঁচায় জড়িয়ে পায়ের একপাটি নাগরা খুলে রয়ে গেল কামরায়, ভ্রুক্ষেপ করল না একটু পরেই বারাকপুর লোকাল আসছে দমদম স্টেশনে বউয়ের কাছে ঠিক সময়ে পৌঁছে যেতে পারবে
পায়ের একপাটি নাগরা ট্রেনেই রয়ে গেছে নতুন জুতোজোড়া পরে ফেলা দরকার কিন্তু ঝকমকে বাক্সটা খুলতে গিয়েও থেমে গেল থাক বরং, বউকে আগে দেখিয়ে নেওয়া দরকার যা জাহাঁবাজ, সিঁধেল নটবর দিন দুপুরে দেড় হাজার টাকার আনকোরা নতুন জুতো হাতিয়ে এনেছে, হয়তো বিশ্বাস করতেই চাইবে না
অগত্যা খালি পায়েই পরের ট্রেন ধরে নটবর দমদম স্টেশনে পৌঁছল নেমে কয়েক পা এগোতেই বউয়ের সমানে প্রণামির মালপত্র নিয়ে বসে আছে কাছে যেতেই এক ঝলক তাকিয়ে প্রায় খেঁকিয়ে উঠল বউ, ‘সে কী গো! দুটো ইস্টিশন আসতেই ভিড়ে জুতো খুইয়ে এসেছ! এই মুরোদ নিয়ে বড় বড় কতা!’
তা ঠিকই ধরেছ গিন্নি!’ বউয়ের খ্যাঁকানিতে আজ একেবারেই দমল না নটবর, ‘কিন্তু দিন দুপুরে ভোগা দিয়ে যে জিনিস হাতিয়ে এনেছি, দেখলে মালুম পাবে, রাত কিংবা ভরদুপুর, সবেতেই এই নটবর সামন্ত এক নম্বর
গটমট করে বউয়ের পাশে বসে গলা নামিয়ে খানিক আগের সব বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে শুরু করেছিল কিন্তু খানিক শুনেই বউ খরখরে গলায় বলল, ‘থাক আর আদিখ্যেতার দরকার নেই খালি পায়ে রূপ যা খোলতাই করেছ, তার উপর বগলে আবার জুতোর বাক্স! রাজ্যের মানুষ যে আড়চোখে দেকে যাচ্ছে, সে হুঁশ আচে! ‘পেসটিজনেই গা! হ্যা-হ্যা না করে জুতোটা আগে পরে ফেল দেখি
বউ ভুল বলেনি এতক্ষণে হুঁশ হল নটবরের জামাইষষ্ঠীর বাজারে গায়ে নতুন ধুতি-পাঞ্জাবির সঙ্গে খালি পা একেবারেই বেমানান ব্যস্ত হয়ে রঙিন ফিতের গিঁট ছাড়িয়ে বাক্সের ঢাকনাটা খুলে ফেলল এবার ভিতরে রঙিন টিসু-পেপারে যত্ন করে জড়ানো রয়েছে জুতো জোড়া নটবরের চোখ দুটো উৎসাহে জুলজুল করে উঠল সযত্নে ভাঁজ খুলে আলতো করে বের করতে গিয়ে প্রায় ভূত দেখার মতো চমকে উঠল তারপর
আঁ!' নটবরের গালের চোয়াল ইঞ্চি কয়েক ঝুলে পড়ল হঠাৎ তাড়াতাড়ি চোখ দুটো কচলে নিল ভেলকিবাজি নাকি! আনকোরা নতুন কোথায়! হাতে উঠে এসেছে ডজন খানেক তাপ্পি-মারা ময়লা এক জোড়া পুরনো জুতো নাগরা জোড়াও যে এর চাইতে ঢের ভাল ছিল! হতভম্ব নটবর হাপুস নয়নে সেই জুতো জোড়া খানিক উলটে-পালটে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল বউয়ের দিকে কোনওমতে বলতে পারল, ‘এ যে ভেলকিবাজি কাণ্ড গো বউ! হায় হায়!’ প্রায় কেঁদে ফেলতে বাকি
নটবরের দিকে তাকিয়ে বউ নেত্যর মুখ এই প্রথম কেমন অন্যরকম দেখাল এমন কাণ্ড কী করে হল, তা বুঝতে তখন অবশ্য তার বাকি নেই বউকে চমকাতে গিয়ে মানুষটা আজ গোড়াতেই গুবলেট করে ফেলেছে তাই চোখ দুটো নাড়ুগোপাল লোকটার বগলে ঝকঝকে জুতোর বাক্স ছাড়িয়ে কখনও তার পায়ের দিকে যায়নি গেলে বুঝতে পারত ভেলকিবাজি হলেও রহস্যটা অতি সরল এতদিন ঘর করছে, বেশ জানে, সেই রহস্য চোরপট্টির পয়লা নম্বর সিঁধেলের মগজে আপাতত পৌঁছুবে না শুধু বলল, ‘তুমি ঠাণ্ডা হয়ে বসো আমি চট করে একজোড়া জুতো কিনে আনচি ট্রেন ফেল হলে পরের ট্রেনে যাব না হয়
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
প্রথম প্রকাশ: ‘নিরুক্ত২০১৬ বইমেলা সংখ্যা

3 comments:

  1. দারুন। খুব সুন্দর বর্ণনা। সাহিত্যবাচ্য এবং উপাদেয়।

    ReplyDelete