এক ভৌতিক মালগাড়ি আর
গার্ড সাহেব
বিমল
কর
সে
কী আজকের কথা! চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগের ঘটনা। আমার তখন কী বা বযেস; বছর বাইশ। অনেক
কষ্টে একটা চাকরি পেয়েছিলাম রেলের। তাও চাকরিটা জুটেছিল যুদ্ধের কল্যাণে। তখন জোর যুদ্ধ
চলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আমাদের এখানে যুদ্ধ না হোক, তোড়জোড়ের অন্ত ছিল না। হাজারে হাজারে মিলিটারি, শয়ে
শয়ে ক্যাম্প, যত্রতত্র প্লেনের চোরা ঘাঁটি, রাস্তাঘাটে হামেশাই মিলিটারি ট্রাক আর
জিপ
চোখে পড়ত।
ওই
সময়ে সব জায়গাতেই লোকের
চাহিদা হযেছিল, কল-কারখানায়, অফিসে, রেলে। মিলিটারিতে তো বটেই।
চাকরিটা পাবার পর আমাদের মাস তিনেকের এক ট্রেনিং হল, তারপর আমায় পাঠিয়ে
দিল মাকোড়া সাইডিং বলে একটা জায়গায়। সে যে কী ভীষণ জায়গা আজ আর বোঝাতে পারব না। বিহারেরই একটা জায়গা অবশ্য,
মধ্যপ্রদেশের গা ঘেঁষে। কিন্তু জঙ্গলে আর ছোট ছোট পাহাড়ে ভর্তি। ওদিকে মিলিটারিদের
এক ছাউনি পড়েছিল। শুনেছি গোলাবারুদও
মজুত থাকত। ছোট
একটা লাইন পেতে মাকোড়া থেকে
মাইল দেড়-দুই তফাতে ছাউনি গাড়া হয়েছিল।
স্টেশন
বলতে দেড় কামরার এক ঘর। মাথার ওপর টিন। ইলেকট্রিক ছিল না। প্লাটফর্ম আর মাটি প্রায়
একই সঙ্গে। অবশ্য প্লাটফর্মে মোরাম ছড়ানো ছিল। স্টেশনের পাশেই ছিল আমার কোয়ার্টার। মানে মাথা গোঁজার
জায়গা। সঙ্গী বলতে এক পোর্টার।
তার নাম ছিল হরিয়া। সে ছিল জোয়ান,
তাগড়া।
টাঙ্গি চালাতে পারত নির্বিবাদে। হরিয়া মানুষ বড় ভালো ছিল।
রামভক্ত মানুষ। অবসরে সে আমায় রামজী হনুমানজীর গল্প শোনাত। যেন আমি কিছুই জানি না রাম-সীতার।
হরিয়াকে আমি খুব খাতির করতাম। কেননা সেই আমার
ভরসা। হরিয়া
না থাকলে খাওয়া বন্ধ। ভাত, রুটি, কচুর তরকারি, ভিন্ডির ঘেঁট,
অড়হর ডাল, আমড়ার টক – সবই করত হরিয়া। আহা, তার কী স্বাদ! মাছ, মাংস, ডিম হরিয়া খেত না।
আমারও খাওয়া হত না। তাছাড়া পাবই বা কোথায়! হপ্তায় একদিন করে আমাদের রেশন আসত রেল
থেকে। চাল, ডাল, নুন, তেল, ঘি, আলু, পিঁয়াজ আর লঙ্কা। ব্যস।
জায়গাটা
যেমনই হোক
আমাদের কাজকর্ম প্রায় ছিল না। সারাদিনে একটা কি দুটো মালগাড়ি আসত। এসে স্টেশনে থামত।
তারপর তিন-চারটে করে ওয়াগন টেনে নিয়ে ছাউনির দিকে চলে যেত। একসঙ্গে পুরো মালগাড়ি
টেনে নিয়ে যেত না কখনো।
আর প্রত্যেকটা মালগাড়ির দরজা থাকত সিল করা। ওর মধ্যে কী থাকত জানার উপায় আমাদের ছিল
না। বুঝতে পারতাম, গোলাগুলি
ধরনের কিছু আছে। হরিয়া তাই বলত।
আমি
অবশ্য অতটা ভাবতাম না। মালগাড়ির দরজা সিল করা থাকবে - এ আর নতুন কথা কী! তার ওপর মিলিটারির
বরাদ্দ মালগাড়ি। খোলা
মালগাড়িতে আমরা যে তারকাঁটা,
লোহালক্কড দেখেছি।
মালগাড়ি
ছাড়া আসত অদ্ভুত এক প্যাসেঞ্জার ট্রেন। জানালাগুলো জাল
দিয়ে ঘেরা। ভেতরের শার্সি ধোঁয়াটে রঙের। কিছু দেখা যেত না। দরজায় থাকত রাইফেলধারী মিলিটারি। হপ্তা-দুহপ্তা
বাদে এইরকম গাড়ি আসত। দু'এক মিনিটের জন্যে দাঁড়াত। আমাকে দিয়ে কাগজ সই করাত। তারপর
চলে যেত ছাউনির দিকে। গাড়িটা যতক্ষণ স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকত – ততক্ষণ কেমন এক গন্ধ
বেরুতো।
ওষুধ ওষুধ গন্ধ।
সঙ্গী
নেই, সাথী নেই, লোক
নেই কথা বলার। একমাত্র হরিয়াই আমার
সাথী। দিন আমার বনবাসে কাটতে লাগল। এসেছিলাম গরমকালে, দেখতে দেখতে বর্ষা পেরিয়ে গেল,
অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। মনে হত পালিয়ে যাই। কিন্তু যাব কেমন করে। চাকরি পাবার লোভে বন্ড
সই করে ফেলেছি। না করলে হয়তো চলত। কিন্তু সাহস হয়নি।
আমার
সবচেয়ে খারাপ লাগত মালগাড়ির গার্ড সাহেবগুলোকে। ওরা কেউ মিলিটারি নয়, কিন্তু স্টেশনে গাড়ি
দাঁড় করিয়ে রেখে
দুচার ঘণ্টা সময় যা কাটত, কেউ এসে গল্পগুজব পর্যন্ত করত না।
ওরা কোন লাট-বেলাট বুঝতাম না। কাজের কথা ছাড়া কোনও কথাই বলত না। আর এটাও বড় আশ্চর্যের
কথা, গার্ডগুলো
যারা আসত – সবই হয় মাদ্রাজি, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, না হয় গোয়ানিজ ধরনের।
একজন
গার্ড শুধু আমায় বলেছিল, চুপি চুপি, “কখনো কোনও কথা জানতে চেয়ো না।
আমরা মিলিটারি রেল সার্ভিসের লোক।
তোমাদের রেলের নয়। আমরা আমাদের ওপরঅলার হুকুমে কাজ করি।
আর কোনও কথা জিজ্ঞেস করবে না। কাউকে কিছু বলবে না।”
সেদিন
থেকে আমি খুব সাবধান হয়ে গিয়েছিলাম।
সব
জিনিসেরই একটা মাত্রা আছে। ওই জঙ্গলে, ওইভাবে একা পড়ে থাকতে থাকতে ছ'মাসের মধ্যেই
আমি যেন কেমন হয়ে গেলাম। পাগল পাগল লাগত নিজেকে। হরিয়াকে বলতাম, “চল, পালিয়ে যাই।”
হরি
বলত, “আরে বাপ রে বাপ।” বলত, “অমন কাজ করলে হয় ফাটকে ভরে দেবে, না
হয়, ফাঁসিতে লটকে দেবে। অমন
কাজ করবে না বাবু৷”
ভয়
আমার প্রাণেও ছিল। পালাব বললেই তো পালানো যায় না। সময় কাটাবার জন্যে আমি প্রথমে অনেক বলে-কয়ে দু'প্যাকেট
তাস আনাই। রেশনের চাল-ডালের সঙ্গে তাস পাঠিয়ে দেয় এক বন্ধু। পেশেন্স খেলা শুরু করি।
তবে কত আর পেশেন্স খেলা যায়! তাসগুলোয়
ময়লা ধরে গেল।
তারপর
শুরু করলাম রেলের কাগজে পদ্য লেখা। এগুতে পারলাম না। পদ্য লেখা বড় মেহনতের ব্যাপার।
শেষে
পেনসিল আর কাগজ নিয়ে ছবি আঁকতে বসলাম। স্কুলে আমি ছেলেবেলায় ড্রয়িং ক্লাসে কেটলি
এঁকেছিলাম, ড্রয়িং স্যার আমার আঁকা দেখে বেজায় খুশি হয়ে বলেছিলেন, “বাঃ! বেশ লাউ
এঁকেছিস তো!
এক কাজ কর – এবার লাউ আঁকতে চেষ্টা কর, ‘কেটলি হয়ে যাবে। তুই সব সময় উলটে নিবি। তোকে হয়তো বলল, বেড়াল আঁকতে, তুই বাঘ আঁকতে শুরু করবি, দেখবি বেড়াল হয়ে
গেছে।”
লজ্জায়
আমি মরে গিযেছিলুম সেদিন। তারপর আর ড্রয়িং করতে হাত উঠত না। বন্ধুদের দিয়ে আঁকিযে
নিতুম।
এতকাল পরে আবার ছবি আঁকতে বসে দেখলুম, ভূত-প্রেত দানব-দত্যিটা হাতে এসে যায়। গাছপালা
মানুষ আর আসে না।
ছবি
আঁকার চেষ্টাও ছেড়ে দিলুম। তবে হিজিবিজি ছাড়তে পারলাম না। কাগজ-পেনসিল হাতে থাকলেই
কিম্ভুতকিমাকার আঁকা বেরিয়ে
আসত।
এইভাবে
শরৎকাল চলে এল। চলে এল না বলে বলা উচিত শরৎকালের মাঝামাঝি হয়ে গেল। ওখানে অবশ্য ধানের
ক্ষেত, পুকুর, শিউলি গাছ নেই যে চট করে শরৎকালটা চোখে পড়বে। ধানের ক্ষেতে মাথা দুলিয়ে
দুলিয়ে
কেউ ডাকার নেই, পুকুর নেই যে শালুকে শাপলায় পুকুর ভরে উঠবে,
আর একটাও শিউলি গাছ নেই যে সন্ধে থেকে ফুলের গন্ধে মন আনচান করবে।
ওসব
না থাকলেও, আকাশ মেঘ আর রোদ
বলে দিত– শরৎ এসেছে। একটা জায়গায় কিছু কাশফুলও ফুটেছিল। এই সময় একদিন একটা ঘটনা
ঘটল।
তখন
সন্ধে রাত কি সবেই রাত শুরু হয়েছে, এঞ্জিনের হুইসেল শুনতে পেলাম। রাতের দিকে আমাদের ফ্ল্যাগ স্টেশনে ট্রেন
আসত না। বারণ ছিল। একদিন শুধু এসেছিল।
কোয়ার্টারে
বসে এঞ্জিনের হুইসেল শুনে আমি হরিয়াকে বললাম, “তুই কচুর দম বানা; আমি দেখে আসছি। বলে
একটা জামা গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কোয়ার্টার থেকে স্টেশন পঁচিশ-ত্রিশ পা।
বাইরে
বেরিয়ে যেন চমক খেলাম। মনে হল, যেন সকাল হয়ে এসেছে। এমন ফরসা! আকাশের দিকে তাকিয়ে
দেখি টলটল করছে চাঁদ। এমন মনোহর
চাঁদ আমি জীবনে দেখিনি। কী যে সুন্দর কেমন করে বোঝাই। মনে হচ্ছে, রুপাের মস্ত এক ঘড়ার মুখ থেকে
কলকল করে চাঁদের আলো
গড়িয়ে পড়ছে নীচে। জ্যোৎস্নায় আকাশ-বাতাস-মাটি‚ সবই যেন
মাখামাখি হয়ে রযেছে। এ-আলোর
শেষ নেই, অন্ত নেই রূপের। আকাশের দু-এক টুকরো মেঘও সরে গেছে একপাশে, চাঁদের
কাছাকাছি কিছু নেই, শুধু জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়ছে।
স্টেশনে
এসে দরজা খুললাম। তার আগেই চোখে পড়েছে, অনেকটা দূরে এক মালগাড়ি দাঁড়িয়ে। এঞ্জিনের মাথার আলো জ্বলছে
না। ড্রাইভারের পাশের আলোও
নয়।
দরজা
খুলে আমাদের লণ্ঠন বার করলাম। লাল-সবুজ লণ্ঠন। লণ্ঠনের মধ্যে ডিবি ভরে দিলাম জ্বালিয়ে। বাইরে এসে হাত নেড়ে নেড়ে লণ্ঠনের
সবুজ আলো
দেখাতে লাগলাম। মানে, চলে এসো, স্টেশন ফাঁকা, লাইন ফাঁকা। ট্রেনটা এগিয়ে এল
না। কিছুক্ষণ পরে দেখি মালগাড়ির দিক থেকে কে আসছে। হাতে আমার মতনই লাল-সবুজ লণ্ঠন।
তার হাঁটার সঙ্গে লণ্ঠন দুলছিল। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না।
এরকম ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। লোকটা
কাছাকাছি আসতে চাঁদের আলোয়
আমি তার পোশাকটা
দেখতে পেলাম। সাদা পোশাক।
গার্ড সাহেবের পোশাক।
দেখতে দেখতে গার্ড সাহেব একেবারে কাছে চলে এল। সামনে। আমি অবাক হয়ে লোকটাকে দেখতে লাগলাম। লম্বা চেহারা, ফরসা,
মাথায় কোঁকড়ানো
চুল। বাঁ-হাতে এক টিফিন কেরিয়ার। গার্ড সাহেব কাছে এসে দাঁড়াল।
দেখল আমাকে।
“তুমি
এই ফ্ল্যাগ স্টেশনে আছ?”
“হ্যাঁ
স্যার।”
“আমাদের
এঞ্জিন বিগড়ে গেছে। মাইল চারেক আগে এঞ্জিনের কী হল কে জানে। থেমে গেল। ড্রাইভাররা
চেষ্টা করেও চালাতে পারল না। ”
“আচ্ছা!”
‘‘বিকেল থেকে জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছি৷ কোনও
সাহায্য নেই। পাবার আশাও নেই। সন্ধের আগে এঞ্জিন আবার চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে, চাকা
ঘষটে। কোনওরকমে এই পর্যন্ত এসেছি। আর এগুনো গেল না।”
আমি
বললাম, “তা হলে খবর দিতে হয়, স্যার!”
“হ্যাঁ,
মেসেজ দিতে হয়। চলো
মেসেজ দাও।”
স্টেশনের
ঘরে এসে টরে-টক্কা যন্ত্র নিয়ে বসলাম। খবর দিতে লাগলাম। ভাগ্যিস টরে-টক্কা যন্ত্রটা
ছিল। তিন জায়গায় খবর দিয়ে যখন মাথা তুলেছি‚ দেখি গার্ড সাহেব চেয়ারে
বসে বসে ঝিমুচ্ছে।
“দিয়েছ খবর?”
“হ্যাঁ
স্যার।”
“এবার
তা হলে খাওয়া-দাওয়া যাক। তোমার
এখানে নিশ্চয়ই জল আছে?”
“ওই
কলসিতে আছে।”
“ধন্যবাদ।”
গার্ড সাহেব উঠে গিয়ে রেল কোম্পানির মগ আর অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসে করে জল নিয়ে বাইরে
গেল।
লোকটা বাঙালি নয়। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানও নয়।
ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলছিল। কোথাকার লোক আমি বুঝতে পারছিলাম না। তার হিন্দি বুলিও স্পষ্ট নয়।
হাত-মুখ
ধুয়ে এসে লোকটা
বলল, “আমি বড় হাংগরি। আমি খাচ্ছি। তুমি কিছু খাবে?”
“না
স্যার। আপনি খান।”
“তুমি
একটু খেতে পার। আমার যথেষ্ট খাবার আছে।”
“থ্যাংক
ইউ স্যার। আমার কোয়ার্টার আছে। আমাদের রান্না হয়ে গেছে। আপনি খান, আপনার খিদে পেয়েছে।
আগে যদি বলতেন‚
আপনাকে কোয়ার্টারে নিয়ে যেতাম। খাবারগুলো গরম
করে নিতে পারতেন।”
গার্ড
সাহেব আমার দিকে চোখ তুলে কেমন করে যেন হাসল। বলল, “তোমার হাতটা বাড়াবে? বাড়াও না?”
আমি
কিছু বুঝতে না পেরে হাত বাড়ালাম। গার্ড সাহেব টিফিন কেরিয়ার থেকে এক টুকরো মাংস
তুলে আমার হাতে ফেলে
দিল। হাত আমার পুড়ে গেল যেন। মাটিতে ফেলে দিলাম।
হাসতে
লাগল গার্ড সাহেব। হাসতে হাসতে খাওয়াও শুরু করল। আমি কাগজে হাত মুছতে লাগলাম। হাতে
না ফোস্কা পড়ে যায় আমার। খেতে খেতে গার্ড সাহেব বলল, “তোমার নাম কী হে ছোকরা?”
নাম
বললাম।
“এখানে
কতদিন আছা?”
“ছ’মাসের
কাছাকাছি।”
“ভালো লাগে
জায়গাটা?”
“না।”
“তা
হলে আছ কেন?”
“কী
করব! চাকরি স্যার!”
“চাকরি৷”
গার্ড সাহেব খেতে লাগল। দেখলাম সাহেব খুবই ক্ষুধার্ত। খেতে খেতে সাহেব বলল, “তোমাদের এখানে আজ কোনও ট্রেন এসেছে?”
“না
স্যার। আজ কোনও গাড়ি আসেনি।”
“আমি
বুঝতে পারছি না। আমার গাড়িটার কেন এরকম হলা? ভালো গাড়ি,
ঠিকই রান করছিল। হঠাৎ থেমে গেল কেন?”
“এঞ্জিন
ব্রেক ডাউন?”
“কিন্তু
কেন?... আমরা যখন ওই ছোট
নদীটা পেরোচ্ছি,
জাস্ট একটা কালভার্টের মতন ব্রিজ, তখন একটা শব্দ শুনলাম। এরোপ্লেন যাবার মতন শব্দ। কিন্তু শব্দটা জোর নয়, ভোমরা উড়ে বেড়ালে যেমন শব্দ হয় সেইরকম।
ব্রেকভ্যান থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। আকাশে কিছু দেখতে পেলাম না।”
“নদীর
শব্দ - ?”
“না
না; জলের শব্দ ন্য়।... আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানো, দু-এক ফার্লং আসার পর এঞ্জিন বিগড়ে গেল।”
“হঠাৎ?”
“একেবারে
হঠাৎ। আর একটা ব্যাপার দেখলাম। খুব গরম লাগতে লাগল। এই সময়টা গরমের নয়, জায়গাটাও
পাহাড়ি। বিকেলও ফুরিয়ে আসছে। হঠাৎ অমন গরম লাগবে কেন? সেই গরম এত বাড়তে লাগল– মনে
হল গা-হাত-পা পুড়ে যাবে। ড্রাইভাররা পাগলের মতন করতে লাগল। পুরো গাড়িটাও
যেন আগুন হয়ে উঠল।”
অবাক
হয়ে বললাম, “বলেন কি স্যার?”
“ঘন্টাখানেক
এই অবস্থায় কাটল। আমরা সবাই নীচে নেমে দাঁড়িয়ে থাকলাম।”
“তারপর?
“তারপর
গরম কমতে লাগল। কমতে কমতে প্রায় যখন স্বাভাবিক তখন দেখি এঞ্জিনটাও কোনওরকমে চলতে শুরু
করেছে।”
“এতো বড়
অদ্ভুত ঘটনা।”
“খুবই
অদ্ভুত।... আরও অদ্ভুত কী জানো!
আমরা গাড়ি নিয়ে খানিকটা এগুবার পর কোথা থেকে মাছির ঝাঁক নামতে লাগল।”
“মাছির
ঝাঁক?” আমার গলা দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বেরুল।
“ও!
সেই ঝাঁকের কথা বলো
না। পঙ্গপাল নামা দেখেছ? তার চেয়েও বেশি। চারদিকে শুধু মাছি
আর মাচ্ছি। আমাদের গাড়িও ছুটতে পারছিল না যে‚ মাছির ঝাঁক পেছনে ফেলে পালিয়ে
আসব। অনেক কষ্টে তাদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছি। আমি তো ব্রেক-ভ্যানের
জানলা-টানলা বন্ধ করে বসেছিলাম। ড্রাইভাররা মরেছে। জানি না, মাছিগুলো এঞ্জিনের কিছু
গোলমাল করে দিয়ে গেল
কিনা! তবে, আগেও তো
এঞ্জিন খারাপ হয়েছিল।”
আমি
চুপ। অনেকক্ষণ পরে বললাম, “এরকম কথা আমি আগে শুনিনি, স্যার।”
“আমারও ধারণা ছিল না।”
গার্ড সাহেবের খাওয়া শেষ। জল খেল। হাত ধুয়ে এল বাইরে থেকে।
“তুমি
জানো,
এখানের ক্যাম্পে কী হয়?” গার্ড সাহেব জিজ্ঞেস করল।
“না,
স্যার। শুনি মালগাড়ি ভর্তি করে গুলিগোলা আসে।”
“ননসেন্স।... এখানে
প্রিজনারস অফ ওয়ার রাখা হয়। যুদ্ধবন্দী। ক্যাম্প আচ্ছে। বিশাল ক্যাম্প।”
আমার
মনে পড়ল প্যাসেঞ্জার ট্রেনের কথা। জানলায় জাল, ধোঁয়াটে কাঁচ। বললাম, “এখন বুঝতে
পারছি, স্যার।”
“তাছাড়া,
হাত-পা কাটা, উন্ডেড সোলজারদের
চিকিৎসাও করা হয়। মরে গেলে গোর দেওয়া হয়।
জান তুমি?”
চমকে
উঠে বললাম, “আমি কিছুই জানি না। মালগাড়ি দেখে ভাবতাম...”
“মালগাড়িতে
হাজার রকম জিনিস আসে। খাবার-দাবার, বিছানা, ওষুধপত্র, ক্যাম্পের নানান জিনিস।”
টিফিন
কেরিয়ার গোছানো হয়ে
গিয়েছিল গার্ড সাহেবের। একটা সিগারেট ধরাল। আমাকেও দিল একটা। বলল, “থ্যাংক ইউ বাবু।... আমি
আমার গাড়িতে ফিরে চললাম। ড্রাইভাররা কী অবস্থায় আছে দেখি গে।... কিন্তু তোমায় সাবধান করে দিয়ে যাচ্ছি, বাবু৷ বি কেয়ারফুল।... আমার মনে হচ্ছে, এদিকে কিছু একটা হযেছে।
কী হযেছে– আমি বলতে পারব না। সাম থিং পিকিউলিয়ার। ম্যাগনেটিক ডিস্টারবেন্স, না কেউ
এসে নতুন ধরনের বোমা
ফেলে গেল কে জানে! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। অত মাছি‚ হাজার হাজার‚ লাখ লাখ...।”
গার্ড
সাহেব চলে গেল। স্টেশন ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি কোয়ার্টারের দিকে আসছিলাম। দূরে গাড়িটা
দাঁড়িয়ে আছে। জ্যোৎস্নার আলোয়
ধবধব করছে সব। হঠাৎ চোখে পড়ল, মালগাড়িটা কিসে যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তারপর দেখি মাছি।
মাছির বন্যা আসছে যেন। দেখতে দেখতে আমার কাছে এসে পড়ল। বৃষ্টি পড়ার মতন মাছি পড়ছিল।
ভয়ে
ঘেন্নায় আমি ছুটতে শুরু করলাম।
ছুটতে
ছুটতে এসে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। মরে যাবার অবস্থা।
ঘুম
ভাঙল পরের দিন। হরিয়া ডাকছিল। দরজা খুলে বাইরে আসতেই হরি বলল, “বাবু, জলদি... গাড়ি আয়া।”
স্টেশনে
গিয়ে দেখি একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন। সেই জানলায় জাল লাগানো, ধূসর কাঁচের আড়াল দেওয়া। ওষুধের গন্ধ ছড়াচ্ছে
প্ল্যাটফর্মে। গার্ড সাহেব কাগজ সই করাতে এগিয়ে এল।
তাকিয়ে
দেখি, গতকালের সেই গার্ড সাহেব নয়, নতুন মানুষ। কিছু বলতে যাচ্ছিলাম আমি; গার্ড সাহেব
এমন চোখ করে তাকাল‚
যেন আমাকে ধমক দিল। কথা বলতে বারণ করল। আমি চুপ করে গেলাম।
কাগজ
সই করে ফেরত দিলাম গার্ডকে। কিন্তু বুঝতে পারলাম না, গতকালের মালগাড়ি, গার্ড সাহেব
আর অত মাছি কোথায় গেল!
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
DARUN/
ReplyDelete